চুলায় বসানো ভাতের পাতিলে টগবগ করে ভাত ফুটছে। চরম লেলিহান শিখা ঘিরে আছে পাতিল টাকে।চুলার চড়া জ্বালের অতিষ্ঠে ভাতের পাতিলের মাড় উতলিয়ে পরে যাচ্ছে চুলায় ।
কিন্তু সেদিকে ভুলেও খেয়াল নেই খাদিজার। চুলার জ্বাল আস্তে দেবার বদলে উল্টো হিংস্র ভঙ্গিতে আরও লাকড়ি দিচ্ছে সে চুলয় । যেন পণ করেছে যে ভাতের মাড় সব উতলিয়ে পরে গিয়ে ভাত পুরে কয়লা হবে তার পর চুলায় তার এই অনবরত জ্বাল দেয়া থামাবে ।
আগুনের তাপে ওর ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। হাতে লাগানো ছাইয়ের কালি সহ কপালের চুল সরাতে গিয়ে নাকে আর কপালে লেগেছে কালি ,আর তাতে ওর সুন্দর চেহারাটা এমন হাস্যকর লাগছে যে প্যাঁচাও ওর চেহারা দেখলে হেসে ফেলবে।
কিন্তু সে ব্যাপারেও ওর বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই। ওই পাতিলের ফুটন্ত ভাতের মতই পাল্লা দিয়ে এই মুহূর্তে ওর মাথার মগজ রাগে, দুখে টগবগ করে ফুটছে। আর এক নাগারে ওর পাতলা ঠোঁটে শুধু রাগন্নিত বকবকের ধোঁয়া বের হচ্ছে ।
‘আহ! হের চেয়ে যদি সারা জীবন কুমারী থাকতাম তাও ভাল হইত; এমন ডরপোক ব্যাডার ঘর করনের পালা হইতে বাঁচাতাম!
‘ও আল্লা ! তোমার কাছে আমি হেই দুক্ষু করিনা যে এমন ব্যাডা আমার স্বামী বানাইছ ক্যান !শুধু কই ! হেরে তুমি কি কইলজা ছাড়া বানাইছো ? যদি হেইডা ই হয় তয় দোহায় লাগে গো আল্লাহ! তারে তুমি বুকের মাদ্দে কইলজা দাও!’
কষ্টে আবেগে গলাটা বুজে এলো খাদিজার। সত্যি তো ওই কালো বেঁটে খাটো লোকটার বুকে কি কলিজা আছে ? যদি থাকতোই তবে কি গাঁও গ্রামের ছেলে হয়েও চিনা জোঁক ভয় পায়! একটা নারকেল গাছে উঠতে ভয় পায়! পুকুরে বা নদীতে নামতে ভয় পায়!
ইশ ! ওর কপালটাই খারাপ , না হয় শরিলে পুরুষ আর মনে মেয়ে মানুষের পরান আলা লোকের সাথে বিয়া হয় ! আনমনে খাদিজা মুখ ভেংচি দেয়। ধুর! তারে মেয়ে মানুষের তুলনা দেয়াও বোকামি । সে তো মেয়ে মানুষের চেয়েও ভীতু !
খাদিজার সারা জীবনের ইচ্ছা মেলায় সার্কেস হলে যদি হাতি আসে,তবে হাতি দেখতে মেলায় যাবে। বড় বড় কুলার মত কান, ইয়া মোটা একটা অদ্ভুত শূর , সেই রকম বড় আর উঁচা হাতির পেট, এমন কতো না গল্পই শুনেছে হাতি নিয়ে ।
সেই হাতি দেখার ভাগ্য মিলল এতো দিনে । আর এখন তার এই ভীতুর ডিম স্বামীটার জন্য হাতি আর দুই চক্ষে দেখা হবেনা!
যখন পাশের বাড়ির সই জরিনা এসে বলল। স্কুল মাঠে এইবার মেলা বসবে আর তাতে সার্কেস আসবে ।
তখন তো খাদিজার মনটা আনন্দে প্রজাপতি হয়ে গিয়েছিলো। হাতি দেখবে । আসলামকে নিয়ে চর্কিতে উঠবে। মশলা দেয়া আলু সেদ্ধ খাবে ,গরম রসগোল্লা খাবে ।মিষ্টি পান খাবে । কাঁচের চুড়ি, বেণী বাঁধার লাল ফিতা কিনবে। আর মেলায় ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াবে।
আরও কত কিছু ...কিন্তু আসলামের কাছে বিপুল আগ্রহে মেলায় যাবার প্রসঙ্গ তুলতেই সব স্বপ্নের বাড়া ভাতে ছাই!
‘অরে বাবা! বউ আমি হাতি ম্যালা ভয় পাই!
ভয়ার্ত গলায় বলল আসলাম ।তার চোখ ভয়ে বড় বড় হয়ে গেছে।
‘আপনি কি কন এগুলান! মাইনসে আবার হাতি ভয় পায় নি!’ খাদিজা বেয়াকুব।
ওর বুকে মেলায় যেতে না পারার আশংকা ধাক্কা দিলো। সেই সাথে আসলামের এই হাতি ভয় পাবার, বিরক্তিকর কষ্ট। মানুষ সাপ ,বাঘ আর জীন ভয় পায় ,কিন্তু হাতি ! হায়রে কপাল!
‘হয় ...হয় ... দারুণ অজগুত! (ভয়ংকর)
‘শূরটা জানো ক্যামুন ! অজগর সাপের লাহান...এমুন মুচড়ায়! দেখলে মনে হয় যেন প্যেছায়া ধরবো !
আসলাম হাস্যকর ভাবে তার হাত ঢেউ কাটিয়ে মুচড়িয়ে দেখাল।
‘না...না... বউ! আমি মইরা গেলেও অই ম্যালায় জামুনা!
খাদিজা কষ্টে আবেগে ।মুখ কাল করে ফেলল। কিন্তু আসলামকে কিছুই বলল না। আসলাম ও দেখল যে খাদিজা । কষ্ট পেয়েছে।
‘বউ তুমি যাও না তুমার সইর লগে’ আমি স্কুল মাডের বাইরে দাঁড়াইয়া থাকুম’ বউয়ের মনে না ব্যথা পায় ।তাই তারা তারি বলল সে ।
না’ আফনে না গেলে আমি যামু না’!
ঠাণ্ডা গলায় বলে খাদিজা। চোখে পানি টলটল করছে। আসলাম যেন সেই পানি না দেখে তাই দ্রুত চোখ থেকে চোখ সরিয়ে ফেলল। আর মুহূর্তয়ে আসলামের সামনে থেকে সরে পরল।
আসলাম হত বুদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে রইলো । বউ যে রাগ করেছে সে টুকু বুঝতে কষ্ট হল না। কিন্তু মেলার কথা ভেবেই ওর পেটের মধ্যে মোচর দিলো । কি করবে বুঝতে পারছে না।
আসলাম মোল্লার সাথে খাদিজা বানুর সাথে বিয়ে হয়েছে আজ ২ বছর। বাবা মা মরা ছেলে আসলাম। সহজ সরল সিধা সাধা একজন মানুষ। চানকাঠী গ্রামের সব গ্রস্থরাই তাকে চেনে। একে তো একজন ভালো মনের মানুষ তার উপর ছেলে বেলা হতে বাবা মা হারা। সবাই তাকে স্নেহের চোখে দেখে ।
চানকাঠী বাজারে তার ছোট একটা মুদীর দোকান আছে । একজন দোকানদার সেই সুবাদেও বেশ পরিচিত মানুষ সে।
আর এক টা ব্যাপারেও সে গ্রামের সবার চেনা সেটা হল তার অতি ভয় প্রীতি। সবাই জানে আসলাম খুবই ভীতু প্রকৃতির লোক।
তার এই ছোট খাটো ভয় নিয়ে সবাই তার সাথে দুষ্টামি করে হাসি তামসা করে। মাঝে মাঝে সেটা মাত্রাধিক ও হয়ে যায় কিন্তু এতে ওর কোন মাথা ব্যথা নেই। তার কালো মুখ সব সময় হাসি খুশি থাকে ।
এত দিন সব ঠিক ঠাকই ছিল কিন্তু বিপত্তি হল যখন আসলাম পাশের গ্রামের সুন্দরী চঞ্চলা চপলা খাদিজা বানুকে বিয়ে করল ।
খাদিজা নিজে এক সাঁতারে কালীগঙ্গা নদী পার হতে পারে । মধ্য দীঘির বড় শাপলা টা এক ডুবে তুলে আনতে পারে । কুল বরই গাছের সবচে উপড়ের ডাল থেকে অনায়েসে কুল পাড়তে পারে । আর হিন্দু বাড়ীর মধ্য জঙ্গলে মনোশা সাপের মন্দিরের আমলকী গাছ থেকে আমলকী ও আনতে পারে।
আর তার স্বামী পুকুরে নামে না মাইটের চেন পায় আটকাবে এই ভয়ে , আর নদীতে নামেনা কামট কামড়াবে এই ভয়ে । এও কি সহ্য করা যায়!
তবে খাদিজা সহ্য করে । মনে কষ্ট রাখে না যে তার স্বামী কালো,কিনবা লম্বায় তার চেয়ে চার আঙ্গুল খাটো,অথবা ঝকঝকে সুন্দর দাঁতের বদলে গাবের আটির মত খয়ের মাখা উঁচু উঁচু দাঁত তার। যে দাঁত বের করে হাসি দিলে চেহারাটা সুন্দর দেখানোর বদলে আরও খারাপ দেখায়! কোন কিছুতেই খাদিজার আপত্তি ছিলোনা এতদিন।
কিন্তু এই মেলায় যাবার ব্যাপারটা ওকে দারুণ কষ্টে ফেলেছে। আসলামের তার সই সাথে মেলায় কথা বলায় ওর মনে অনেক অনেক আঘাত পেয়েছে । সে কি বুঝতে পারে না একজন স্ত্রী তার জীবনের সকল সুখের মুহূর্ত গুলো তার ভালোবাসার সেই মানুষটির সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চায় যে তার জীবন মরণের সঙ্গী!
খাদিজা কি ভাবে মেলায় গিয়ে একা একা চরক ঘুল্লিতে উঠবে । বা খুব আনন্দ খুশি করবে । যেখানে তার মনের মানুষটিকেই পাশে পাবে না ! তাও আবার জটিল কোন কারণ থাকলে মনটাকে বুঝ দেয়া যায়।কিন্তু তার স্বামী মেলায় যাবেনা এই জন্য যে সে হাতি ভয় পায় ! চর্কি দেখলে বমি আসে !
খাদিজা ...নিজের অশান্ত মনটাকে বোঝাতে পারে না । তার সরল আঁখি বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু নামতে থাকে। আর বেরসিকের মত চুলার ভাত ও উথলিয়ে পড়তে থাকে।
(২)
এর ঠিক দুই দিন পর খাদিজা সকালের রান্না বান্না শেষে চুলার পিঠের ছোট উঠান টা ঝাড়ু দিচ্ছিল।এমন সময় উঠানের ফাঁড়ি (শুকনো সুপারির পাতার তৈরি) বেড়ার দরজা ঠেলে আসলাম বাড়িতে ঢুকল।
তার হাতে বড় একটা বোয়াল মাছ ঝুলছে। বোয়াল মাছের মুখের ভেতরে চিকন দড়ি আটকানো।সেই দড়ির অন্ন প্রান্ত আসলামের হাতের মুঠোয়। আর ওর মাথায় ধামা (বেতের তৈরি একপ্রকার গোল ঝুরি) ।
খাদিজা তো অবাক। প্রায় এক ঘণ্টা আগে সকালের খাবার খেয়ে আসলাম দোকানে গিয়েছিলো।
জোহরের আযানের আগে তো তার বাড়ি ফেরার কথাই না। হটাত সে এই অবেলায় তার বাড়ি ফেরার কারণ কি ? তাও আবার এমন বাজার সদাই সহ! ও হাতের ঝাড়ু রেখে । স্বামীর দিকে এগুলো।
‘অতিত (মেহমান ) আইছে বউ অতিত’ !
আসলামের চেহারায় আনন্দ যেন ধরে না।
‘কে আইছে হেইডা কন না!
আসলামের হাতের মাছ নিতে নিতে বলে খাদিজা। ওর চোখ ফাঁড়ির দরজায়। কিন্তু সেখানে কোন মেহমানের ছায়াও নেই।
‘আমাগো সবুজ... আইছে ...সবুজ !’
‘কি কন! সবুজ ভাইজান! হেয় গঞ্জের থেকে আইল কবে ?
‘আইজ ই আইছে ! আমাগো গেরামে কাম আছে..হেইয়ার লাইগ্যা আমাগো এদিক আগে আইছে....অগো বাড়ি এহোনো যায় নাই ...
‘দোকান ডা ক্যাবল খুলছি এমন সময় দেহি ... গাডে নামতাছে নৌকা দিয়া...দূর থাইকা পরথমে চিনবার পারি নাই পরে বুকে জরাইয়া ধরছি!
‘না বাজারের ব্যাবাকের লগে কথা কইতাছে’ ম্যালা তাগেদা! (ভীষণ ব্যস্ত) শুধু আমারে কইল যে ‘ভাবীরে কইয়া আয় আইজ তুই হারা দিন আমার লগে থাকবি’’ ‘আমি কইছি থাকমু...তয় আমাগো ঘরে কয়ডা ভাত খাওয়াই লাগব কিছুতেই আইজ তরে ছাড়া ছাড়ি নাই’ অয় রাজি হইছে!
আসলামের হাসিতে যেন বিশ্ব জয়ের সুখ। খুশির বন্যা খাদিজার চোখেও । স্বামীকে এমন বাঁধ ভাঙা খুশিতে ভাসতে খুব কমই দেখেছে। আর এই খুশির যথেষ্ট কারণ ও আছে । কেননা এই সবুজ শেখ আসলামের জীবনের এক স্পেশাল মানুষ ।
আসলাম খাদিজার উদ্দেশ্যে বত্রিশ দাঁত বের করে সম্মতির হাসি দিলো । সত্যি তার বউয়ের বুদ্ধির তুলনা নাই ।
আসলেই তো এমন পুরান কাপড়ে আর আনাওয়া অবস্থায় কি সবুজের মত বড় ঘরের শিক্ষিত পোলার সঙ্গে ঘুরা যায়!
সবুজের সঙ্গে বুক মেলানোর সময় অর কাপুর থেকে কি সুন্দর ঘ্রাণ আসছে । মনে হইল যেন আতরের শিশি নাকে উলটাইয়া পরছে! কিন্তু বুরান দেয়ার দরকার কি। বদনি লইয়া নাইয়া আইলেই হয়। অবশ্য মুখে কিছু বল্লনা সে ।
‘বউ! তুমারে একখান কতা কই’!
গত দুইদিন আকাশ পাতাল ভেবে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে অবশেষে তা খাদিজাকে বলার সাহস করলো।
‘কন!’
‘শুক্কুর বার আল্লায় দিলে তুমারে লইয়া মেলায় যামু’ যদি আমারে হাতি চাবাইয়া খাইয়াও ফ্যালায় তয় ও জামু!’
আসলাম মুখ বিকৃত করে ঢোক গিলল। মনে হল যেন এই মুহূর্তয়েই ও হাতির দাঁতের নিচে চাপা পড়েছে !
‘হুনেন! হাতি মাইনসেরে চাবাইয়া খায় না ...খায় ...বাগ, বাল্লুকে’!
খাদিজা হাসি চেপে বলল । মনে মনে এত ভীষণ খুশি হয়েছে । যে আনন্দে চড়ুই পাখীর মত সারা উঠানে একটা উড়াল দিতে ইচ্ছে করল ।
‘খাইলে খাউক! তবুও যামু’ শুধু তুমি মুখ খান অমন কালা কইরা রাইখনা! লক্ষ্মী বউ আমার!
সেইদিন সারা টা বেলা খাদিজা অনেক রকম রান্না বান্না আর ঘর দোর গুছানোতে ব্যস্ত রইলো। মাগরিবের নামাজ শেষে তছবী পড়া আর কুরআন তেলাওয়াত শেষ হতে নাহতেই। ওদের ঘরের সামনের বারান্দার দরজায় খট খট আওয়াজ পড়ল ।
ও শেষ বারের মত সামনের বারান্দার ফিটফাট খাট আর টেবিলটা চেয়ে দেখল। সব ঠিক আছে দেখে দ্রুত দরজা খুলল । দরজার ওপাশে আসলামের পরিচিত গলা ছাড়াও অপরিচিত একটি গলার আওয়াজ ওর কানে আসছে।
‘বউ কি কি রানছো’?
ভিতরের ঘরে এসেই জিজ্ঞেস করল আসলাম ।
তার মাথায় টুপী, মসজিদ থেকে নামাজ পরে এসেছে। অজু করেছে সেই জন্য মুখটা সজীব লাগছে । বুঝাই যাচ্ছে না যে সারাদিন সে সবুজের সাথে গ্রামের সব মাথাওয়ালা গেরস্থদের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছে!
কিন্তু সব কিছুর মধ্যেও আসলামের চোখে কেন জানি অদ্ভুত এক বেদনা উপচে পরছিলো যা খাদিজার চোখে ফাঁকি দিলো না। তবে ও এই মুহূর্তয়ে কিছুই জিগ্যেস না করাটা ভাল মনে করলো।
‘আফনে যে বোয়াল মাছ আনছেন তাই দিয়া কাঁচা টক বাগুন (কাঁচা টমেটো) বাজা বাজা কইরগা রানছি’ খোপের ঘর (হাঁস মুরগী থাকার ঘর) দিয়া সব চেয়ে তেল তেলা হাঁস টা জবাই দিয়া রানছি ...সাথে শিয়াই পিডা (চালের গুড়ি আর লবণ দিয়ে পানির ভাপে বানানো হয়)
‘তার পর পলাউ পাতা দিয়া কয়ডা পলাউ ও রানছি’ লগে নাইহেল (নারকেল ) দুদে ডিম কোর্মা’ এক রকমের ভাজি’ আর দুই রকমের মিষ্টি পিডা ও বানাইছি!
‘আইছছা! খুব ভালা হইছে’
আসলাম তার বউয়ের রান্নার ফিরিস্তিতে পুরো পুরি সন্তুষ্ট হল।
‘হুনো বউ! আমাগো তুমি খাওয়া দিয়া দাও ...এশার নামাযের পর উডানে আমাগো চকিদার বাড়ীর সব মানুষ আইবো! হেইয়ার আগে খাওন শেষ করা ভালো!
‘ক্যান! সবাই আইবো ক্যান! কিছু অইছে নাকি ?
‘আমি কি কমু তুমি নিজের কানেই হুইনো!
আসলামের গলায় জোর নেই । যেন সব হারিয়ে দুর্বল একজন মানুষ। স্বামীর হটাত এই অদ্ভুত আচরণে খাদিজা শঙ্কিত ও বিস্মিত হল। কিন্তু কিছু বলল না। দ্রুত খাবার রেডি করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
চকিদার বাড়ির বড় উঠান মানুষে ভর্তি। প্রায় প্রতি ঘরের কর্তারা উপস্থিত হয়েছে । সাথে সবার অল্প বয়স্ক ছেলে বা নাতি পুতি। যার যার ঘরের পিড়ি বা পাটিতে বসা সবাই ।মহিলারাও আলো থেকে দূরে অথবা ফাঁড়ির অন্ধকারে দল বেঁধে দাঁড়ানো। সবাই সবার সাথে ফিসফিস করে কথা বলছে।
অনেকে অনুমান করার চেষ্টা করছে যে মাতব্বর আলী শেখের ছেলে সবুজ শেখ কি এমন জরুরী কথা বলবে যে আজ সবাইকে এই ভাবে ডাকল!
মৃত্যুর আগে তার বাবা যখন এই চানকাঠী গ্রামের মাতব্বর ছিল তখন বিপদে আপদে এমন বহুবার হয়েছে কিন্তু । তার ছেলের এই ঘটনায় সবাই অবাক। সবাই একটা চাঁপা উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষায় রইল।
‘ভাইজানেরা ও মা বইনেরা ...সকলরে আমার সালাম ...
সবুজের গলার আওয়াজে, উপস্থিত সকলের অপেক্ষার সমাপ্তি হল । সবুজ আসলামের ঘরের সামনের খেজুর গাছটার নিচে চেয়ারে বসা।আর তার কাছেই আসলামও একটা ছোট পাটিতে বসে আছে ।
‘আমি জানি আইজ আমারে আপনেগো এই ভাবে ডাকবার জন্য সবাই হয়তো আমার আব্বার কথা স্মরণ করতেছেন’
‘এই গ্রামের সুখে দুঃখে আব্বা এমন ভাবে বহুবার আপনেগো এক সাথে ডাকছে’ আর আফনেরাও সকল বালা মুসীবত একসাথে কান্দে কান্দ বাইন্ধা মুকাবেলা করছেন’
‘আইজ আমার আব্বা বাইচা নাই’ তাই আমি আপনাগো সামনে হাজির হইছি...জানাইতে আইছি যে সামনে আমাগো বিপদ ...মহা বিপদ!
এত টুকু বলে সবুজ থামল। উপস্থিত মানুষেরা যেন নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে। সবার মুখে আতংক। কেউ বুজতে পারছে না কি বলবে।
‘ভাইজান আমাগো খুইলা কন কি বিপদ!
একজন সময় উপযোগী প্রশ্নটি করলো।
‘আমাগো জীবনের সব চাইতে বড় বিপদ’ আপনেরা হয়ত হকলেই জানেন যে ঢাকায় শহরে পাকিস্তানী মিলিটারিরা ক্যামনে আমাগো ভাইগো আর বইনগো মারছে’ আমাগো সূর্য সন্তান ছাত্র ভাইগো রক্তে সবুজ ঘাস লাল হইছে ... আমাগো গুরুজন শিক্ষক গো রক্তে রাস্তা ভিজ্জে...
‘রাস্তায় কারফিউ... যে বাইরাবো তারেই গুলী করবো...রাস্তায় রাস্তায় লাশ আর লাশ...কেউ কাউরে বাঁচাইতে আইতে পারেনা ...কেউ কাউরে সহযোগিতা করতে পারে না ....সবাইর শুধু জীবনের ভয় ... মরণের ভয়... কহন কারে ধরবো আর গুলী কইরা বুকটা ঝাঁজরা কইরা দিবো।
‘তাগো বিরুদ্ধে কেউ কতা কইতে পারবানা ... তাগো চোখে চোখ উডাইতে পারবানা ...
‘তয় এত কিছুর মধ্যেও আমরা কিন্তু থাইমা নাই...আমারা আমাগো ভয় পাওয়া মুরগীর লাহান লুকাইয়া রাহি নাই ...আমরা মুকাবেলা করতাছি...ওরা আমাগো অত্যাচার করবো ...লুইটা লইব ...অগো চাকর বানাইয়া রাখবো...আমাগো ঘরবাড়ী জ্বালাইয়া দিবো....আমাগো অধিকার লইয়া ছিনিমিনি খেলব!
‘আর আমারা বইয়া বইয়া তামশা দেখুম ! না তা আর হইব না এইবার সময় আইছে পতিশদ লবার ..এইবার সময় হইছে জানাইয়া দেবার ...
‘আমারা অগো মতন না ... আমাগো ও বুকের পাডা আছে ...আমারাও লড়তে জানি প্রতীবাদ করতে জানি ...আমরা কারো অধীনে না ...আমারা স্বাধীনে থাকতে চাই..
আমাগো মা’ রে আমাগো দেশ রে আর বন্দী দেখতে চাইনা ...আমাগো মাডি এইবার মুক্ত হইব ...স্বাধীন হইব...
‘কিন্তু ভাইজানেরা ...আমরা যে আইজ বড় অসহায় ...বড় দুর্বল...তাদের প্রশিক্ষণ লওয়া মেলিটারি... গোলা বারুদের অভাব নাই...শক্তির অভাব নাই ... আমাগো উপর এমন ভাবে ঝাঁপাইয়া পড়ছে যেন সিংহ আর ইন্দুর... ‘হেগো বুটের তলায় আমাগো বুকের রক্তর দাগ’ আর আমরা ইন্দুর হইয়া থাকমু?
‘না ! কোন দিন ও না!
‘তাই ভাইজানেরা আমি আফনেগো একটা কথা স্মরণ করাই ... সেইডা হইল... ‘একের ভারী বোঝা/ দশের হালকা সোজা ...
‘আইজ আমাগো সেই সব মুক্তিবাহিনী সন্তান গো আমাগো সবাইরে দরকার...তাগো হাতে হাত রাখতে হইব ...কান্দে কান্দ মিলাইতে হইব... কারণ এই দ্যাশ টা তো শুধু হেগর না ...এই দ্যাশের সন্তান যে আমরাও ...আইজ আমাগো মা’ ...আমাগো দ্যাশ বিপদে ...তারে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাগো সবাইর ...
‘ভাইজানেরা আমি সেই সব সোনার সন্তান মুক্তিবাহিনীর পক্ষ হইতে আপনা গো এই কথা পৌছাইতে আইছি যে ...আমারা যেন যে যেভাবে পারি সেই ভাবে আমাগো শত্রুর উপর ঝপাইয়া পড়ি... ভয় পাইয়া পিছাইয়া না ...তুমুল হুংকারে অগো উপর হামলাইয়া পড়ি’...
‘কাইল ফজরের নামাযের পর আমাগো কালীগঙ্গা নদীর চানকাঠি ঘাঁট দিয়া একটা ট্রলার মুক্তি বাহিনী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সীমান্ত বরাবর রওনা দিবো...আমি সেই ট্রলারের চানকাঠি গ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধা’...
‘আমার লগে আমাগো গেরামের বর্তমান মাতব্বরের দুই পোলা সিদ্দিক আর কুদ্দুস ও থাকব’ সাথে আরও কিছু সাহসী ভাইয়েরা’
‘আমার ভায়েরা... যদি কেউ আমার সাথে যাইতে চান সেই ট্রলারে...আমাগো মা’য়রে মুক্ত করার জন্য ...আমাগো স্বাধীনতার জন্য’ ...
‘আমাগো সামনের ভবিষ্যৎ ...ভাই বইন ,পোলা মাইয়ারে একটা বন্দী জেলখানায় না একটা নিজের আপন দ্যাশে তারা যেন থাকবার পারে সেই জন্য... তয় সকালে আমাগো বাজারের মসজিদে ফজরের নামাযে শরীক হইয়েন ...
‘ আমার আর কিছুই বলার নাই ...কারো কিছু জানার থাকলে ...আমারে জিগাইতে পারেন’ ...।
সবুজের দীর্ঘ কথা শেষ হতেই । পুরো মজলিশ জুড়ে যেন চাপা শোরগোল উঠল । সবাই উত্তেজিত । যে যার মত সবুজের কথার নিজ নিজ দৃষ্টি ভঙ্গীতে প্রকাশ করছে একে অপরের সাথে ।
কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ হয়ে যাবার পর ও কেউ সবুজের আহ্বানে সারা দিয়ে সামনে এগিয়ে এলো না। এরই মধ্যে দুবার আসলাম তার নিজের বসার যায়গা ছেড়ে তার ঘরের বারান্দায় অন্ধকারে বসা খাদিজার কাছে গিয়ে কি এক অজানা ব্যাপারে কথা বলল ।
অবশেষে সেই উঠান ভর্তি মানুষের মধ্য থেকে একজন বলিষ্ঠ ও দৃঢ় স্বরে বলে উঠল। ‘আল্লাহ্ বাঁচাইয়া রাখলে ...আমি আসলাম মোল্লা হকলের সামনে কথা দিলাম ...কাইল সকালে মসজিদে ফজরের নামাযে শরীক থাকমু’ ইনশাআল্লাহ্ !
একজনের এই কথার উপর উঠানের প্রায় সকলেই উচ্চস্বরে হেসে দিলো। যেন আসলাম যুদ্ধে যাবার কথা না জানি কত বড় একটা হাসির কথা।
শুধু মাত্র সবুজ । উল্লাসিত চোখে আসলামের দিকে তাকাল। ওর দুই চোখে বন্ধুর প্রতি অকৃতিম শ্রদ্ধা আর গর্ব। সে বিশ্বাসই করতে পারছেনা যে উঠান ভর্তি মানুষের মধ্যে আসলাম সেই ব্যক্তি যে সবার আগে নিজের আপন দেশের তরে তার নিজের জীবন উৎসর্গ করলো ।
‘হয় সবুজ ভাই ...আসলামরে লইয়া যান আপনার লগে ...অয় তো আবার ম্যালা ডরপোক ... বন্দুক না ধরুক ...আপনাগো রাইন্দা বাইন্দা খাওয়াতে পারবো... আর আমাগো তো ...ঘরে পলাপাইন ...বুড়া বাপ মা আছে... অর তো কেউ নাই ...হেই দিক দাও ভালা হয় ...আমরা হের বউরে দেইখা রাখুম’ কুনো সমুস্যা নাই...কি কন মিয়ারা?
উপস্থিত সকল মানুষের মধ্য হতে একজন দীর্ঘদেহী শক্ত পোক্ত লোক বলে উঠল।
সবুজ হাল্কা হ্যারিকেনের আলোতে সেই মানুষ টিকে এক দেখাই চিনতে পারলো । তার নাম নিবাদশা। এই চকিদার বাড়ির সবচেয়ে সাহসী ও শক্তিশালী মানুষ। সে দেখতে ছোট খাটো পেশী বহুল গেরিলার মতো।
হটাত করে সবুজের প্রচণ্ড রাগ লাগলো। উপস্থিত দুজন মানুষের আসলামের উদ্দেশ্যে এমন তাচ্ছিল্য ও উপহাস করা কথায় ওর মন উত্তেজিত ও রাগন্নিত।
‘নিবাদশা ভাই মুক্তিবাহিনীর আপনারে দরকার’ আপনে হইলেন গিয়া এই চকিদার সবচাইতে সাহসী মানুষ’ আর প্রত্যেক দিন ভাবীরে পিটাইয়া পিটাইয়া গায় বানাইছেন ম্যালা শক্তি...কাজেই আসলামের মত বলদ ছলদ যাওনের কি দরকার’ তারচেয়ে ভালা আপনে চলেন’!
সবুজের গলায় যেন আগুণের হল্কা ঝরল।
সবুজের এই চটুল কথায়... নিবাদশা ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেলো । সে ভেবেছিলো এইবার সুযোগ পেয়েছে আসলামের বউয়ের তার সেই পুরনো প্রতিশোধ নেবার।
ছেমড়ির সাহস কত ! অর নিজের বউরে অয় নিজে পিটাইয়া কচু ভর্তা বানাইব তাতে কার কি ! কত্ত বড় সাহস ! হুমকি দেয় যে আবার মারলে লাল দালানের (কারাগার ) ভাত খাওইবো ! গেরামের কেউর সাহস নাই অর চক্ষে চোখ তুইল্লা কথা কবার । আর অই মাইয়ার সাহস কত !
কিন্তু সবুজের কথায় আর কথা বল্লনা সে। আর বলার দরকার ডা কি ফায়সালা তো হইয়াই গেছে । অই বলদ আসলাম তো সাহসেও বলদ আর বুদ্ধিতে ছাগল...
হেহ ! বউ পোলা মাইয়া ছাইড়া যুদ্ধে যাওন! মেলিটারি মানুষ মারে তয় আমাগো কি ?হেইয়ার লাইগা যুদ্ধ করন লাগবো! আহাম্মক আর কারে কয় ! নিবাদশা তার বিশাল মুখটা কুঁচকে বিকৃত করে ফেলল।
(৪)
তার পরের দিন ...
ফজরের নামায শেষে একদল মুক্তিকামী সৈনিক জড়ো হল চানকাঠি বাজারের মসজিদ প্রাঙ্গণে।
সবার মুখে এক অজানা উল্লাস । নিজের দেশ স্বাধীনের জন্য ওরা যাচ্ছে । এই কথা ভাবতেই সবার বুকে গরম রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠছে।
তবে মনের গভীরে নাড়া দিচ্ছে বিষাদের সুর । আপন গ্রাম ছাড়তে হবে ...ছাড়তে হবে পরিবার পরিজন । করতে হবে অসীম ত্যাগ স্বীকার ।
কেউ জানেনা কবে দেখা হবে আবার প্রাণপ্রিয় মানুষ গুলোর সাথে । অথবা শত্রুর মুখো মুখি দাড়িয়ে ফিরে আসতে পারবে কি জীবন নিয়ে ...।
নামায শেষে মসজিদের ইমাম সাহেব সবুর মুন্সী অনেক ক্ষণ বিভিন্ন দোয়া দুরুদ পড়ে উপস্থিত সকল মুক্তি সেনাদের মাথায় ফুঁ দিলেন । গভীর আবেগে সবার কপালে চুমু দিলেন । তাঁর দু চোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা নামছে ।
‘তাগোরে তুমি স্বাধীন পতাকা হাতে গাজী বানাইয়া ফেরত দিওগো আল্লাহ!
সবুর মুন্সী আরো অনেক কিছু বলে দোয়া করতে চাইলেন কিন্তু প্রচণ্ড আবেগে তার গলা ভেঙ্গে গেলো ...কিছু বলার মত শব্দ বের হলনা । আর তিনি হু হু করে কেঁদে দিলেন ।
শুধু সবুর মুন্সী নয় । চানকাঠি গ্রামের উপস্থিত সকল মানুষে দু চোখ ভেঙ্গে পানি নামলো।
কালীগঙ্গা নদীর প্রীতিটি ঢেউ । আর বাতাসের অস্পষ্ট কান্নার আওয়াজ যেন একটি কথাই বলল।
মুক্তি চাই ! মুক্তি! ...স্বাধীনতা চাই! স্বাধীনতা!
‘বউ গো আমারে তুমি কও যে... তুমি আমার উপর রাজী খুশি আছো ... যুদ্ধে জাইতাছি জানিনা যান লইয়া ফেরত আইতে পারমু কিনা ...যদি তুমার বুকে দুক্ষ থাকে তয় যে মইরাও শান্তি পামুনা’ ...রে বউ! ... ।
‘আফনে এইগুলান কি কইতাছেন!’ আফনে ফিরা আইবেন ...আল্লাহ দিলে নিশ্চয় ফিরা আইবেন... স্বাধীন পতাকা হাতে লইয়া...যুদ্ধে জই হইয়া ফিরবেন ...
খাদিজা অঝোর ধারায় কাঁদছে । মনে হচ্ছে যেন কষ্টে ওর বুকটা ভেঙ্গে যাবে । প্রিয়তম স্বামী বিদায় নিচ্ছে। জানেনা জীবনে আর কখনো দেখতে পারবে কিনা ওই মায়াময় মুখটা ...জীবনের হাসি কান্নায় তার হাতের মধুর ছোঁয়া পাবে কি এই হাতে...। আর কখনো .....।
‘বউ কাইন্দ না কাইন্দ না! তুমার চোখের পানি যে আমি সইতে পারিনা’
‘আমি আইজ জাইতাছি যুদ্ধে যেন ...আর কোন দিন আমন একজন স্বামীর তার বউয়ের কাছে দেশ স্বাধীনের জন্য বিদায় না নেয়া লাগে’ আমাগো ভবিষ্যৎ জামাই বউরা যেন সুখে শান্তিতে পোলা মাইয়া লইয়া জীবন পার করতে পারে’
‘ স্বামী গো এইডা যে আমার সুখের কান্দন ! আমি যে কত বড় ভাইজ্ঞবান তা আফনেরে ক্যামনে বুঝাই’ আমি যে একজন বীর মুক্তি জইদ্ধার বউ!
‘আমি কি ভাইঙ্গা পরতে পারি? আমার সৌভাগ্য যে আমি আফনের স্ত্রী...শুধু আফনে আমারে কন যে আফনে আমার উপর রাজী খুশি আছেন’
আসলাম তার হাত দিয়ে খাদিজার চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। ওর নিজের চোখেও অশ্রুর বন্যা। ক্যামনে সে স্ত্রীকে বলে যে তাঁকে কতটা জানপ্রান দিয়ে ভালোবাসে। আর ভালোবাসার মানুষ কে যে শুধু ভালই বাসা যায় । তাঁকে কি কখনো দুক্ষ দেয়া যায়! বা তার প্রতি দুঃখ রাখা যায় !
‘তুমারে লইয়া যে মেলাতেও যাওয়া হইলনা...সবুজে কইলো মেলার ট্রলার নাকি আইবার দেয়নাই অরা আমাগো এদিক’
‘মনে বড় কষ্ট... তুমার মনের আশাডা মিডাই তে পারলাম না’
‘চাইছিলাম বৈশাখ মাসে আউকের বিডা (আখের খেত ) বেইচা তুমার জন্য এক জোড়া কানের দুল গড়াইয়া দিমু, তাও হইলো না...আমি তো তুমারে কিছুই দিতে পারলাম না রে বউ! বিয়ার পর হইতে তুমি আমার জইন্ন আমার সংসারের জইন্ন কত কষ্ট করছ...!
আসলাম আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল , কিন্তু খাদিজা তার হাত দিয়ে আসলামের মুখ আটকে দেয় ।
‘আফনে এই কতা কইয়েন না’!
‘তাইলে আমি নিজেরে মাফ করতে পারমুনা ...এই দুনিয়ার সবচে বেশী সুখি মানুষ আমি... আফনের ঘর যে আমার জান্নাত’
‘একজন স্ত্রীর জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া তার স্বামীর ভালোবাসা ...তার মহব্বত ...আফনে আমারে যে মায়া মহব্বত দিছেন ...এই জগতের সকল ধন সম্পদ ও তার বরাবর হইতে পারব না ...এই দুনিয়াবি সকল সম্পদ দের চাইতেও যে আপনে আমার প্রিয়’...!
আসলাম দুচোখ ভর্তি জল নিয়ে খাদিজার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর বুকটা শান্তিতে ভরে গেছে । খাদিজা তার স্ত্রী ভাবতেই মনের ভিতরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করল।
কিন্তু এখন নিজের ভেতরের আবেগ কে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না । নিজের বুকের ভেতরটা একটা পাথর চাপা দিল ও ।
‘বউ তয় এখন আমারে দোয়া দেও’ অরা সবাই আমার জইন্ন বার চাইতাছে (অপেক্ষা করছে) ‘তুমি নিজের দিক যত্ন রাইখো...জেমুন পরিস্থিতি ই হউক না ক্যান ...বুকে হিম্মৎ রাখবা ...আল্লাহ্র উপর ভরসা করবা ..
‘আমি তুমারে কতা দিতাছি ...ইনশাআল্লাহ্ ! আবার তুমার কাছে ফিরা আইমু ...আবার আমরা এক সাথে গঞ্জে যামু... পূর্ণিমার রাইতে নদীর গাডে দুই জনে বইয়া মুড়ির মোয়া খামু আর তুমারে গীত শুনামু ...।
আসলামের গোলা ভেঙ্গে গেলো আবেগে আবারো। স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে ...নিজের চোখের পানি মুছে। মন টাকে শক্ত করলো ।
‘আমিও আফনেরে কতা দিলাম ... জীবনে আফনার আছি মরণেও আফনার থাকমু ... যদি আর কুনো দিন আমাগো সাক্ষাৎ না ও হয় ... ‘দুক্ষ করবেন না ... আমি জান্নাতে আফনের জইন্ন অপেক্ষা করমু ...সেইদিন আল্লায় দিলে জনম জনমের তরে আমারা কাছা কাছি থাকমু... আমি আফনেরে কতা দিলাম... ‘আল্লাহ্ ভরসা আফনে এইবার আসেন’ ... ।
খাদিজা অশ্রুর সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে ... প্রাণপ্রিয় স্বামীর মুখ পানে শেষ বারের মত তাকিয়ে... তাঁকে বিদায় জানালো । ওর বুকের মধ্যে আকাশ ভাঙা ঝড় তুফান যেন পাঁজরের হাড় ছিন্ন ভিন্ন করে নিচ্ছে ।
*** আসলাম ও সবুজেরা যুদ্ধে যাবার প্রায় দুই মাস পরে চানকাঠি গ্রামের কালীগঙ্গা নদীর বুক কেটে হানাদার বাহিনীর গান বোট প্রবেশ করে ।
তারা স্কুল ঘরে তাদের ক্যাম্প গড়ে তুলে । এবং পুরো চানকাঠি গ্রাম ও তার আশেপাশের অঞ্চলে তাদের বর্বর তাণ্ডব চালায় ।
নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়া । মুক্তি সেনা সন্দেহে কালিগঙ্গা নদীতে জীবন্ত বস্তা বন্দী অবস্থায় যুবক ও মধ্য বয়সী পুরুষ দেরকে নির্মম ভাবে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা ও গুলী করে হত্যা করা ।
এবং বাড়ির যুবতী মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হত্যা করা সহ আরো বিভিন্ন রকম অপরাধ ও পৈশাচিকতায় মেতে উঠে ।
চকিদার বাড়ির ‘নিবাদশা’ খুব অল্প সময় হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন রকম সহযোগিতার করার মাধ্যমে তাদের সহযোগী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে ।
নিবাদশা নিজেও হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে খারাপ কাজে জড়িয়ে পরে । সে নিজের হাতে হানাদার দের ক্যাম্পে চকিদার বাড়ির কিশোরী ও যুবতী মেয়েদের তুলে নিয়ে যায় ।
এবং তার পুরনো শত্রুতার যের ধরে সবার উপর নির্যাতন করে। সে জবরদস্তীতে খাদিজাকে ও তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে ।
পরবর্তীতে এক অমাবস্যার রাতে। সাহসী প্রতিবাদী ও বীরাঙ্গনা খাদিজা বানু বিভিন্ন কলা কৌশলে ও তার সূক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা আর প্রবল সাহসিকতার বলে... আরো কয়েক জন সাহসী বন্দী মেয়ের সহযোগিতায়...গোপনে গোপনে ক্যাম্পের বন্দী সকল মেয়েদের কে মুক্ত করে...এবং
স্কুল ঘরের হানাদারদের গোলাবারুদ অস্ত্র রাখার ঘরে আগুণ ধরিয়ে দেয় । সৈন্যরা কিছু বুঝে উঠার আগেই ...আগুনের ছোঁয়াতে বিকট শব্দে... স্কুল ঘরের প্রায় পুরুটাই বিস্ফোরিত হয়ে ধ্বসে পরে ।
সাথে সাথে নিবাদশা সহ বেশীর ভাগ হানাদার বাহিনী জ্বলন্ত ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে ....ও .. মৃত্যু বরণ করে এবং বাকীরা মুক্তি সেনাদের হামলা ভেবে জীবন ভয়ে পলায়ন করে।
অন্য অন্য সকল মেয়ে সহ অক্ষত অবস্থায়... খাদিজা বানু আবারো নিজের ধ্বংস স্তূপ ঘরে ফিরে আসে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হাতে আসলামের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে । ***
(সমাপ্ত )
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াছিম
গল্পটা বড় বলে ভাবলাম পরে পড়বো, পড়তে শুরু করলাম এবং পড়ে ফেললাম, শুরু হয়েছে চমৎকার ভাবে, একটু একটু করে ঘটনার মধ্যে প্রবেশ করে মনে হল এক দৌড়ে বের হয়ে আসলাম....... শেষটায় খুব তাড়াহুরা করা হয়েছে, তবে এক কথায় চমৎকার।
এফ, আই , জুয়েল
# গল্পটা বেশ বড় এবং অনেক ভালো । কিছু কিছু আঞ্চলিক শব্দ পরিহার করে এরুপ আরো গল্প লিখতে থাকো । --- বই ছাপাতে পারবা । --- নব বর্ষের শুভেচ্ছা রইলো ।
রীতা রায় মিঠু
তানি, তোমার লেখাসহ এই ব্লগের প্রায় প্রতিটি লেখা আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ি, তবে সব সময় 'সময়' করে উঠতে পারিনা, ধীরে ধীরে পড়ি। 'মুক্তিযোদ্ধা' টপিকের উপর যতগুলো গল্প পড়লাম, এমন আনন্দ অন্য টপিকে পাইনি। সৌরভে মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে! খুব ভালো লেগেছে।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।